যক্ষা ও ধারনা
টিউবারকুলোসিস বা যক্ষা হল একটি ইনফেকশন বা প্রদাহ যা সাধারণত ফুসফুসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যদিও হৃৎপিণ্ড, অগ্ন্যাশয়, মাংসপেশি ও থাইরয়েড গ্রন্থি ছাড়া শরীরের প্রায় যে কোন স্থানেই যক্ষা হতে পারে। এমনকি কিডনি, মেরুদন্ড অথবা মস্তিষ্ক পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে।
এটি একমাত্র জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট প্রদাহজনিত রোগ যা সারা বিশ্বে মৃত্যুর কারন হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। যক্ষার ভয়াবহতা এমন যে, দেখা গেছে ২০১৫ সালে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ এর কারনে মারা গিয়েছে ও ১০ কোটি ৪০ লক্ষ এর কারনে অসুস্থ হয়েছে!
১৮৮২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কোঁখের এই রোগের কারন আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত ১৮ ও ১৯ শতকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতে মহামারি হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
রবার্ট কোঁখের এই আবিষ্কারের পরে এই রোগ নির্মূলে ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়, ও পরবর্তীতে বিভিন্ন ওষুধ আবিষ্কারের কারনে বিশ্ব ব্যাপী এই রোগের প্রকোপ আস্তে আস্তে কমে আসছে, এমনকি জাতিসঙ্ঘ আশা প্রকাশ করছে যে, ২০২৫ সালের মাঝে এ রোগটি সারা বিশ্ব থেকে পুরোপুরি নির্মূল হবে।
যক্ষার প্রকারভেদ–
চিকিৎসকগণ সাধারণত দু ধরনের যক্ষার কথা বলে থাকেন;
– সুপ্ত যক্ষা
যক্ষা সৃষ্টিকারী জীবাণু সুপ্তাবস্থায় থাকে ও শারীরিক কোন লক্ষণ প্রকাশ করেনা বা ছড়ায় না। কিন্তু যে কোন সময় এটি সক্রিয় হতে পারে।
– সক্রিয় যক্ষা
লক্ষণ প্রকাশকারি যক্ষা ও সংক্রামক ধরনের।
ধারনা করা হয় যে, সারা বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ জনগণ সুপ্ত যক্ষা দ্বারা আক্রান্ত এবং এর মাঝে ১০ শতাংশ যে কোন সময় সক্রিয় রোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, ধূমপায়ী বা এইডস বা অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছেন।
টিবি সাধারণত যে কোন বয়সের ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে, তবে সবচেয়ে বেশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
যক্ষার কারন–
মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক জীবাণুর দ্বারা সৃষ্ট যক্ষা বা টিবি সাধারণত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, আক্রান্ত ব্যাক্তির ( যাদের ফুসফুসে জীবাণু থাকে) হাঁচি, কাশি, সর্দি, কফ ছাড়াও হাসি বা কথার মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে।
তাই দেখা যায়, সংক্রামক রোগ হবার কারনে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি কাছের মানুষ হয় তবে এই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। আবার সক্রিয় জীবাণুবাহী ব্যাক্তি যদি কমপক্ষে ২ সপ্তাহ পূর্ণ চিকিৎসা পান তাহলে এই রোগ সাধারণত ছড়ায় না।
অন্যদিকে যক্ষা চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়ে আসছে, দেখা যায় এর যথেচ্ছ ব্যবহারের কারনে যক্ষা সৃষ্টিকারী জীবাণুর নতুন নতুন প্রজাতি তৈরি হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক ঠিক মত কাজ করছেনা ও মাল্টি ড্রাগ রেসিস্ট্যাণ্ট টিবি ( এম ডি আর – টিবি) তৈরি হচ্ছে, যার মাধ্যমে সুস্থ ব্যাক্তি আক্রান্ত হচ্ছে।
মাল্টি ড্রাগ রেসিস্ট্যাণ্ট টিবি চিকিৎসা যোগ্য ও আক্রান্ত ব্যাক্তি পূর্ণ সুস্থতা লাভ করে থাকেন, তবে বিশেষ যক্ষা নিরামক ওষুধের মাধ্যমে।
ফুসফুস জনিত যক্ষার লক্ষণ–
- সাধারনত তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে খুসখুসে কাশি
- জ্বর– বিশেষ করে বিকালে বা সন্ধ্যায়
- কাশির সাথে যদি কফ এবং রক্ত দেখা যায়
- শ্বাস নেয়ার সময় অথবা কাশি বা হাঁচির সময় বুকে ব্যথা হওয়া
- হটাত করে ওজন কমে যাওয়া
- শারীরিক দুর্বলতা বা অবসাদ লাগা
- খাদ্যে অরুচিভাব বা ক্ষুধা না লাগা
- রাতে ঘাম হওয়া
ফুসফুস বহির্ভূত যক্ষার লক্ষণ–
- চামড়ায় যক্ষা– চামড়া ফুলে যায়, লাল হয়ে ওঠে, ঘা হয় এবং কালো কালো দাগ হতে পারে।
- অন্ত্র ও খাদ্যনালীর যক্ষা– লক্ষণগুলো হল পেটফাঁপা, পেটব্যথা, ক্ষুধামন্দা, বদহজম, পাতলা পায়খানা, খাবারে অরুচি ইত্যাদি।
- গ্রন্থি বা গ্লান্ড এর যক্ষা– গ্রন্থি ফুলে যায়, লাল হয়ে যায় এবং ব্যথা হয়। শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থির মধ্যে থেকে সাধারণত ঘাড়ের গ্রন্থিগুলোতে এই যক্ষা বেশি হতে পারে।
- অস্তিসন্ধি, হাড় অথবা শিরদাড়ার যক্ষার ক্ষেত্রে আক্রান্ত অঙ্গ ফুলে যাবে, ব্যথা হবে এবং শিরদাড়া বাঁকা হয়ে যেতে পারে।
- কিডনির যক্ষা– পেটের পাশে, কোমড়ের উপরে ব্যথা হয়। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত হতে পারে তবে অনেক সময় তা খালি চোখে দেখা যায় না। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া এবং ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে।
তবে এসব লক্ষণ শুধু মাত্র প্রাথমিক ধারনার জন্য, পুরপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ বাঞ্ছনীয়।
যক্ষার ঝুঁকি–
যদি সময়মত ও নিয়ম মত চিকিৎসা না করা হয়, তবে যক্ষা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে– যদিও বাতাসবাহিত রোগ হওয়ার কারনে মূলত ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে থাকে, কিন্তু যক্ষার জীবাণু রক্তের সাথে মিশে শরীরের অন্যান্য স্থানে প্রভাব ফেলে। যেমন–
- মেনিনজাইটিস
- স্নায়ুতন্ত্রের ব্যাথা
- অস্থিসন্ধির ক্ষয় ও তীব্র ব্যাথা
- যকৃত ও কিডনি ( বৃক্ক) বিকল
- হৃদরোগ ইত্যাদি।
যক্ষার প্রভাবক –
কম রোগপ্রতিরোধকারী ব্যক্তিরাই সাধারণত বেশি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে থাকে ও সক্রিয় জীবাণু বহন করে থাকে। যেমন–
- এইডস ( এইচ আই ভি) এ আক্রান্ত ব্যাক্তি
- ধূমপায়ী
- ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যাক্তি
- কিছু ক্যান্সার
- অপুষ্টি জনিত কারন
- কিডনি রোগাক্রান্ত ব্যাক্তি
- মাদকসেবী
- পরিযায়ী বা ঘন ঘন বিদেশ গমন কারি
দেখা গেছে, আফ্রিকা– বিশেষত পশ্চিম আফ্রিকা বা সাব– সাহারান আফ্রিকা, আফগানিস্তান, চীন, রাশিয়া, উত্তর আমেরিকা, পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের মানুষের মাঝে যক্ষার প্রকোপ বেশি থাকে।
রোগ সনাক্তকরন –
যক্ষা সনাক্তকরণে সাধারণত রক্ত ও কফ পরীক্ষা করা হয়ে থাকে, এছাড়া এক্স–রে ও অন্যান্য সাধারণ পরীক্ষা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করা হয়ে থাকে।
চিকিৎসা ও প্রতিকার –
দেখা গেছে যে, বয়স ভেদে সঠিক মাত্রার, সঠিক সময়ের ও সঠিক এন্টিবায়োটিক এর মাধ্যমে যক্ষা পুরোপুরি নির্মূল সম্ভব।
এম ডি আর টিবি এর ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক ছাড়াও অন্যান্য কিছু ওষুধের প্রয়োজন হয় চিকিৎসার জন্য। যক্ষার জন্য সাধারণত লম্বা সময় ধরে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে থাকে, তবে পুরোপুরি নির্মূলে সাধারণত ৬ মাসের ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এর চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে, যক্ষা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, যেমন– গাঢ় কমলা রঙ এর প্রস্রাব, প্রথম কয়েকদিন হালকা জ্বর, জন্ডিস, অরুচিভাব, বমি ভাব ইত্যাদি। তবে এ জন্য ভয়ের কারন নেই। সঠিক চিকিৎসা পেলে আক্রান্ত ব্যাক্তি সহজে ভাল হতে পারেন। সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ওষুধের কোর্স সঠিকভাবে সম্পন্ন করা। এটি ঠিকমত না করলে এম ডি আর টিবির সৃষ্টি হতে পারে। তাই ডট পদ্ধতি ( ডাইরেক্টলি অবসারভড থেরাপি বা সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চিকিৎসা) কাম্য, এর মাধ্যমে পরিবারের সদস্য বা চিকিৎসা সহকারীরা আক্রান্ত ব্যাক্তির ওষুধ সেবনের ব্যাপারে সবসময় পরিচর্যা করেন ও ওষুধ নিয়মিতকরন নিশ্চিত করেন।
প্রতিকার হিসেবে কিছু সাধারণ নিয়মকানুন হল, যক্ষার জীবাণুর সঙ্ক্রমণ না ঘটানো; যেমন আক্রান্ত ব্যক্তি ও সুস্থ ব্যাক্তি সবসময় মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন , বিশেষ করে স্কুলে ও জনসমাগম স্থানে। আক্রান্ত ব্যাক্তি রাতে বা দিনে আলাদা ঘরে বিশ্রাম নিবেন ইত্যাদি।
সদ্যজাত বাচ্চাদের বিসিজি ভ্যাক্সিন দেয়া হয়ে থাকে এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা তৈরির অংশ হিসেবে। বাংলাদেশে ই পি আই এর অংশ হিসেবে এ টিকা টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সত্যি বলতে টিকা দেয়ার পর ও অনেকে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অন্যান্য প্রভাবমূলক কারনে।
যক্ষার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ–
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা বিশ্বে যক্ষা প্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ৩০ তম। প্রতিবছর সারা দেশে প্রায় ৩,৬২,০০০ নতুন যক্ষার রোগী শনাক্ত হচ্ছে, এর প্রায় ৭৩,০০০ মারা যাচ্ছেন এর প্রকোপে। অন্যদিকে, বছরে প্রায় ৯,৭০০ এম ডি আর যক্ষার রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিবি প্রোগ্রামের আওতায় ২০৩০ সালের মাঝে যক্ষার কারনে ৯০ শতাংশ মৃত্যুহার ও ৮০ শতাংশ প্রকোপ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তা ছাড়াও দেশজুড়ে বিনামূল্যে যক্ষারোগ নির্ণয়, রোগী সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদানের জন্য বিভিন্ন সরকারি – বেসরকারি ও সহকারী অঙ্গসংগঠন, মেডিকেল কলেজ, গ্রাম, উপজেলা, থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্র কাজ করে আসছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আস্তে আস্তে টিবি বা যক্ষা আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে, যা প্রশংসনীয়। উপমহাদেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম যা এম ডি আর যক্ষার দ্রুত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৭৫ শতাংশ সাফল্য লাভ করেছে। এভাবে চলতে থাকলে, আশা করা যায় একসময় যক্ষামুক্ত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
One thought on “যক্ষা ও ধারনা”
ওয়েব সাইটটি থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম। আরও নতুন নতুন পোষ্ট চাই।